আগস্টে চলে যাওয়া বিখ্যাতরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
আগস্ট এলেই মনের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। কষ্টে যন্ত্রনায় যেন দুমড়ে-মুচড়ে যাই। আগস্ট মাস দেশ এমন কিছু কতিপয় মানুষকে হারিয়েছে যাদের শুন্যস্থান কোনদিন পূরণ হওয়ার নয়। আগস্টে যারা স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যু বরণ করেছে তাদের মধ্যে যেমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যক ও সাংবাদিক রয়েছেন তেমনি রয়েছে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষক।
তাদের সবার মৃত্যুই দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের বৃহৎ শুণ্যতার সৃষ্টি করেছে। কাউকে না কাউকে নিভৃতে কাঁদিয়েছে কিংবা আজও কাঁদায়। অতীতের বিভিন্ন বছরের আগষ্টে যারা মুত্যুবরণ করেছে তাদের সকলের কথা উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও অন্তত কিছু বিখ্যাত মানুষের কথা উঠে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান:
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে তার ভূমিকা,ত্যাগ ও অনবদ্যকর অবদান বাঙ্গালী জাতিসত্ব্যা আজীবন স্মরন করবে। এই দিনে কিছু বিপদগামী সেনা সদস্যদের হাতে তিনি নিহত হোন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট বাঙালী জাতির আত্মছবি অঙ্কিত করার নিপুন কারিগর তথা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুত্যু হয়। জীবনের শেষ চার বছর ছিল তার ধারাবাহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়। এই সময়ের মধ্যে দুইবার অসুস্থ অবস্থায় থাকতে হয়েছিল তাকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল কবির।
তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সেরে উঠতে পারেননি। এই সময় রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে সৃজিত কিছু অবিস্মরণীয় পংক্তিমালা। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কাজী নজরুল ইসলাম:
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট বাঙালীদের প্রাণের কবি তথা সাম্য, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। সর্বশেষ ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন।
হুমায়ুন আজাদ:
২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট রাতে একটি পার্টি থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আবাসস্থলে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
এছাড়া ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশনের সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন হুমায়ুন আজাদ। এ সময় তাকে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মাথায়, মুখে ও ঘাড়ের উপর মারাত্মক জখম করে।
হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর জার্মান সরকারের তত্ত্বাবধানে মিউনিখে তার এপার্টমেন্টে পাওয়া সব জিনিসপত্র ঢাকায় তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ওই জিনিসপত্রের ভেতরেই পাওয়া যায় তার হাতের লেখা তিনটি চিঠি। চিঠি তিনটি আলাদা তিনটি পোস্ট কার্ডে লিখেছেন বড় মেয়ে মৌলিকে, ছোট মেয়ে স্মিতাকে এবং একমাত্র ছেলে অনন্য আজাদকে। অনুমান করা হয়, ওই লেখার অক্ষরগুলোই ছিল তার জীবনের শেষ লেখা।
কবি শামসুর রহমান:
কবি শামসুর রহমান(১৯২৯ – ২০০৬) স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিক কবি এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬ টা ৩৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার কবিতায় তিনি নিজেকে একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যার ফলে ১৯৯৯ সালে তিনি হত্যা চেষ্টার স্বীকার হোন। সৌভাগ্যবশত তিনি বেঁচে যান।
তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনির: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিকে অপূরণীয় ক্ষতির দিন ১৩ আগস্ট। চার বছর আগে এই দিনে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও চলচ্চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর।
তারেক মাসুদ ছিলেন একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ। তিনি এদেশে সুস্থধারার চলচিত্র নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তার এ অবদান জাতি স্মরণ রাখবে। আর মিশুক মুনির ছিলেন একজন প্রতিভাবান চিত্রগ্রাহক ও চিত্র নির্দেশক ছিলেন।
শহীদ আব্দুল মালেক:
১৯৬৯ সালের ২রা আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অব পাবলিক এডমিনিষ্ট্রেশন(নিপা) ভবনে (বর্তমান ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ) এ শিক্ষানীতির উপর ১ টি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনা সভায় ইসলামী শিক্ষানীতির উপর ৫ মিনিটের যৌক্তিক বক্তব্যে উপস্থিত সবার চিন্তার রাজ্যে এক বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করে।
পরবর্তীতে এই কারণেই ১২ আগষ্ট শহীদ আব্দুল মালেক ২/৩ জন সাথীকে সাথে নিয়ে টিএসসির পাশ দিয়ে তার হলে যাওয়ার সময় লোহার রড-হকিষ্টিক নিয়ে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তাকে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নিয়ে ইটের উপর মাথা রেখে উপরে লোহার রড- হকিষ্টিক দিয়ে উপর্যপুরি আঘাত করে রক্তাক্ত ও অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। এই অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার তিনদিন পর ১৫ আগস্ট তিনি মারা যান।
ক্ষুদিরাম বসু:
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের শুরুর দিকের সর্বকনিষ্ঠ এক বিপ্লবী। ফাঁসি মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর, ৭ মাস ১১ দিন। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসির মাধ্যমে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যু কার্যকর করা হয়।
১৬ বছর বয়সে ক্ষুদিরাম পুলিশ স্টেশনের কাছে বোমা পুঁতে রাখেন এবং ইংরেজ কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করেন। একের পর এক বোমা হামলার দায়ে ৩ বছর পর তাকে আটক করা হয়। তার মামলার বিচারক ছিলেন জনৈক বৃটিশ মি. কর্নডফ এবং দুইজন ভারতীয় লাথুনিপ্রসাদ ও জানকিপ্রসাদ। ফাঁসির রায় শোনার পরে ক্ষুদিরামের মুখে হাসি দেখা যায়। তার বয়স খুব কম ছিল। বিচারক কর্নডফ তাকে প্রশ্ন করেন, তাকে যে ফাঁসিতে মরতে হবে সেটা সে বুঝেছে কিনা? ক্ষুদিরাম আবার মুচকে হাসলে বিচারক আবার প্রশ্নটি করেন। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ভোর ছয় টায়। ফাঁসির মঞ্চ ওঠার সময়ে তিনি হাসিখুশি ছিলেন।
প্রতিক্ষণ/এডি/এমএস